নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিভিন্ন সমস্যায় ধুঁকছে প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জ জেলা। যানজট, হকারদের দখল ফুটপাত, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, অবৈধ যানবাহন চলাচল সবকিছু মিলিয়ে পুরো শহর বর্তমানে স্থবির হয়ে থাকে। এর আগে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরকে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর করা হলেও শহরের চিত্র এখনো আগের মতোই রয়েছে। বছরের শুরুতে শহরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, এসপি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা আইভী, নারায়ণগঞ্জ দুটি আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান উপস্থিত ছিলেন।
সভায় প্রত্যেকেই শহরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেন। এর সুফল মাসখানেক থাকলেও এরপর আবারও আগের রূপে ফিরে আসে নারায়ণগঞ্জ। এদিকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শহরে আরও বিশৃঙ্খলা বাড়ে। শৃঙ্খলা আনতে শুরুতে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে শহরের কোনো ইজিবাইক প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু পরে তা আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে নাসিক থেকে শুরু হয় যৌথ অভিযান। অভিযান চলাকালে শহরে কিছুটা শৃঙ্খলা থাকলেও অভিযানের পর আবারও একই অবস্থা হয়ে যায়।
বর্তমানে শহরের অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হকারদের দৌরাত্ম্য প্রচুর বেড়েছে। এর ফলে ফুটপাত থেকে শুরু করে সড়কের একটি অংশ এখন হকারদের দখলে রয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসন এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। এর ফলে ক্রমশ শহরের বিশৃঙ্খলা বাড়ছেই। এর আগে গতবছরের শেষের দিকে প্রশাসনের লোকজন একাধিকবার হকার উচ্ছেদ করলে ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যার পর ফুটপাতে হকার বসতে দেওয়ার দাবিতে শহরজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন হকার নেতারা। বিক্ষোভ মিছিলে এই হকারদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা হকার্স সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ ও মহানগর হকার্সলীগ সভাপতি রহিম মুন্সি। এদিন তারা বিক্ষোভ মিছিল শেষে সমাবেশে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন। তারও আগে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারিতে এই হকার ইস্যুতেই এক লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। এদিন হকার ইস্যুতে মেয়র আইভী সমর্থকদের সাথে হকার সংঘর্ষে মেয়র আইভী সহ প্রায় অর্ধশত লোক আহত হয়। এসময় প্রকাশ্যে গুলি ছোড়া সহ ইটপাটকেল বর্ষণের চিত্র দেখা যায়। আর এই ঘটনায় বহু আলোচনা সমালোচনার এক পর্যায়ে পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে আকার ধারণ করলে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিটি কর্পোরেশন ও হকারসহ বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ বৈঠকে হকারদের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে বসা নিষেধ করে দেয়া হয়। তারপরেও হকাররা কোনো বাঁধা নিষেধ মানছেন না।
এদিকে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ফিটনেস বিহীন গাড়ি নগরীতে না চলা, রাস্তায় লোড আনলোড, অবৈধ পার্কিং বন্ধ, লাইসেন্স বিহীন অটো রিকশা প্রবেশ নিষিদ্ধ করে মাইকিং করা হয়। এই নিরিখে পরে গত ১৪ নভেম্বর শহরে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ এবং সেনাবাহিনী। এসময় চলাচলের অনুমতি না থাকায় গ্রীণ ঢাকা ও আশিয়ান পরিবহনের ২ টি এসি বাস, ১ টি লেগুনা, ২ টি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও ১ টি সিএনজিকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বন্ধন পরিবহনের একটি বাসকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক কিলোমিটারের ছোট এই শহরে বিভিন্ন পরিবহনের রেজিস্ট্রিকৃত বাসের সংখ্যা রয়েছে ২৮৩টি। সেই সাথে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ঢাকা-নারায়ণঞ্জ রুটে নতুন করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনটি পরিবহনের বাস চালু করা রয়েছে। যাদের বাসের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। যেগুলো নিয়মিত ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে যাতায়াত করে। এর বাইরেও অনেক বাস রয়েছে। যাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একই সাথে বৈধ ও অবৈধ ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার। যেগুলো আগে সচরাচর শহরে প্রবেশ করার সুযোগ পেতো না। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ট্র্যাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যখন তখন যেভাবে খুশি শহরে প্রবেশ করছে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান, ট্যাংক লরি, ট্রাক, লেগুনা ও ট্রাক্টর তো রয়েছেই। তাদেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার কারণে শহরের রাস্তায় বের হলেই ৫ থেকে ১০ মিনিটের রাস্তায় সময় লাগছে ঘণ্টা পর ঘণ্টা। এদিকে শহরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও একেবারেই নেই বলা চলে। রাস্তার পাশে বিশাল মার্কেট নির্মাণ করা হলেও সেগুলোতে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আর যেসকল মার্কেটগুলোর নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোতে পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান, শো-রুম, রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেয়া হয়েছে। ফলে শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সড়কের উপরে গাড়িপার্কিং করে রাখে অসংখ্য প্রাইভেটকার, বাইক। নির্দিষ্ট লেনের গাড়িগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না পেয়ে আটকে থাকে দীর্ঘসময় ধরে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে শহরে বৈধ স্ট্যান্ডের থেকে অবৈধ স্ট্যান্ডের পরিমাণ অনেক বেশি। তাদেরকে যেন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক শহরে বৈধ ইজারা দেয়া স্ট্যান্ড রয়েছে মাত্র ৫টি। এছাড়া বাকি যত স্ট্যান্ড রয়েছে সবগুলোই অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়াতেই রয়েছে কমপক্ষে ৮টি অবৈধ স্ট্যান্ড। শহরে যানজটের প্রধান স্থানগুলো হচ্ছে চাষাঢ়া চৌরাস্তা মোড়, রাইফেল ক্লাব মোড়, নূর মসজিদ মোড়, পপুলার পয়েন্ট, সায়াম প্লাজা, দিগুবাবুর বাজার রোড, ২ নম্বর রেলগেট, মণ্ডলপাড়া সেতু ও নিতাইগঞ্জ মোড়। মূলত বঙ্গবন্ধু সড়কটি নারায়ণগঞ্জবাসীর ঢাকায় যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়ক। শহরে বহু কারখানা থাকায় সড়কটিতে যানবাহনের চাপ থাকে অনেক বেশি। ওইসকল অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বছরের পর বছর ধরে বহালই রয়ে যাচ্ছে। একই সাথে রুট পারমিট ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি গুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী উঠানো-নামানো করে আসছে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে বড় ছোট দুর্ঘটনা।